









ড. মোহাম্মদ সাদিক। ২০১৬ সালের ২ মে থেকে বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস কমিশনের (পিএসসি) চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করে গত ১৮ সেপ্টেম্বর অবসরে যান। প্রায় সাড়ে চার বছর দায়িত্ব পালনকালে পিএসসিতে ব্যাপক পরিবর্তন আনেন তিনি। নিয়োগে স্বচ্ছতা ও আস্থার বিষয়টি নিশ্চিত করতে নেন নানা পদক্ষেপ।





তার সময়ে প্রায় ৫০ হাজার ক্যাডার ও নন-ক্যাডার পদে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। বিসিএসের দীর্ঘসূত্রতা কমিয়ে আনা, পরীক্ষা কাঠামোয় পরিবর্তন, একাধিক পরীক্ষকের মাধ্যমে উত্তরপত্র যাচাইসহ নানা ইতিবাচক পদক্ষেপের জন্য চাকরিপ্রত্যাশীদের আস্থা ও জনপ্রিয়তার প্রতীক হয়ে ওঠেন ড. সাদিক। সদ্যবিদায়ী এ পিএসসি চেয়ারম্যান একান্ত সাক্ষাৎকার দিয়েছেন জাগো নিউজ-কে। কথা বলেছেন মুরাদ হুসাইন।





দায়িত্ব পাওয়ার পর প্রশ্নফাঁস, নকল, দুর্বৃত্তায়ন যেন না চলতে পারে সেটি নিশ্চিত করা হয়
জাগো নিউজ : সরকারি কর্ম কমিশনে (পিএসসি) চার বছর চার মাসের বেশি সময় দায়িত্ব পালনকালে আপনি কোনো প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হয়েছেন কি? প্রতিবন্ধকতাগুলো দূরীকরণে কোন ধরনের ব্যবস্থা রেখে যাচ্ছেন?





ড. মোহাম্মদ সাদিক : আমাদের যেকোনো পদের চাইতে প্রার্থী অনেক বেশি থাকে। এ কারণে ক্যাডার, নন-ক্যাডার এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির চাকরির নিয়োগের ক্ষেত্রে বিপুল-সংখ্যক প্রার্থী অংশ নিয়ে থাকেন। তাদের মধ্য থেকে আমরা যোগ্যদের নির্বাচন করে নিয়োগের জন্য সুপারিশ করে থাকি।





সাধারণত বিসিএস পরীক্ষার বিষয়ে সবাই খবর রাখেন। পাশাপাশি বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানে পিএসসি’র মাধ্যমে নিয়োগ পরীক্ষা হচ্ছে, প্রার্থী ছাড়া সে খবর রাখা হয় না। বছরে এ ধরনের শতাধিক নিয়োগ পরীক্ষার আয়োজন এবং ফল প্রকাশ করতে হয়। নিয়োগ পরীক্ষার জন্য কমিশনের ওপর কোনো ধরনের হস্তক্ষেপ করে না সরকার। স্বাধীনভাবে কমিশন কাজ করে। তবে যেহেতু বিসিএসসহ সব নিয়োগের লিখিত পরীক্ষার জন্য ধার করা কেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠান নির্বাচন করতে হয়, এ কারণে সময়মতো কেন্দ্র পাওয়া যায় না।





প্রিলিমিনারি পরীক্ষার প্রতিটি বিষয়ের জন্য চার সেট প্রশ্ন তৈরি করে প্রতিটি প্রশ্নের জন্য আবার চার কালার করতে হয়। গোপনীয়তা রক্ষা করে প্রশ্ন প্রণয়ন, নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ, বিতরণ এবং নকলমুক্ত পরিবেশে সুষ্ঠুভাবে পরীক্ষা আয়োজন ও ফল প্রকাশের ক্ষেত্রে নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়ে থাকে। একসঙ্গে ২৬টি ক্যাডারের নিয়োগ কার্যক্রম করতে হয়। একটি ক্যাডারের জন্য ৮০ থেকে ৯০ ধরনের প্রশ্ন তৈরি করতে হয়। পরীক্ষা ও ফলাফলকে চ্যালেঞ্জ নিয়ে পিএসসিকে কাজ করতে হয়। আমি দায়িত্ব পাওয়ার পর পরীক্ষা শুরুর আগে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে বৈঠক করে প্রশ্নফাঁস, নকল, দুর্বৃত্তায়ন যেন না চলতে পারে, সেটি নিশ্চিত করা হয়।





পিএসসির কাছে সবার প্রত্যাশা থাকে যে, পরীক্ষা ও ফলাফল প্রকাশে স্বচ্ছতা ও যোগ্যতাকে প্রকৃত মাপকাঠি হিসেবে বিবেচনা করা হবে
জাগো নিউজ : আপনার কোনো কাজ কি অসমাপ্ত আছে? সেগুলো আপনার উত্তরসূরী সম্পন্ন করবেন বলে আপনি মনে করেন কি?
ড. মোহাম্মদ সাদিক : পিএসসিতে ধারাবাহিক কাজ করতে হয়। আমার আগের চেয়ারম্যান যেখানে শেষ করেছেন, সেখান থেকে আমি শুরু করি। আমি যাওয়ার পর নতুন চেয়ারম্যান সেখান থেকে শুরু করবেন। আমি ৪০তম বিসিএসের লিখিত পরীক্ষা নিলেও তার ফল প্রকাশ করতে পারিনি। নতুন চেয়ারম্যান সেটি করবেন।





তবে পিএসসিতে টিমওয়ার্ক করে কাজ করতে হয়। বিজ্ঞ সদস্য ও সচিব মিলে কাজ করতে হয় বলে সব কাজের ধারাবাহিকতা থাকে, চেয়ারম্যান এ টিমের প্রধান হিসেবে কাজ করেন। আমি মনে করি, পিএসসির কাছে সবার প্রত্যাশা থাকে, পরীক্ষা ও ফল প্রকাশে স্বচ্ছতা ও যোগ্যতাকে প্রকৃত মাপকাঠি হিসেবে বিবেচনা করা হবে, এটি নিশ্চিত করতে আমরা দলবদ্ধভাবে কাজ করেছি।





নন-ক্যাডারের চাহিদা সময়মতো পাওয়া যায় না। অনেক প্রতিষ্ঠান নিজেদের শূন্য পদের হিসাব জানে না
বর্তমানে বিসিএসের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা পড়ালেখা করতে লাইব্রেরিতে ভিড় করছেন। বিসিএস ক্যাডার হতে হলে বেশি বেশি পড়ালেখা করতে হবে। আমি যদি যোগ্য হই তবে কোনো তদবির ছাড়াই চাকরি পাওয়া যাবে বলে প্রার্থীরা বিশ্বাস করেন। আমার পর যিনি আসবেন, তিনিও এ বিষয়গুলোকে গুরুত্ব দেবেন বলে আমি বিশ্বাস করি।





ড. মোহাম্মদ সাদিক : বাংলাদেশে প্রথম বাজেট ছিল ৭৮৬ কোটি টাকার। বর্তমানে কয়েক লাখ কোটি টাকার বাজেট হচ্ছে। সেই ধারাবাহিকতায় বর্তমানে কর্মসংস্থানও তৈরি হয়েছে। প্রথম-দ্বিতীয় শ্রেণির চাকরিতে পিএসসির আওতায় নিয়োগ হয়ে থাকে। এসব স্তরে পদ শূন্য থাকছে না। বর্তমানে তৃতীয়-চতুর্থ শ্রেণির অনেক পদ খালি থাকছে, এটিও পিএসসির আওতায় দেয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।





বিসিএস পরীক্ষার চূড়ান্ত ফল প্রকাশের আগে আমরা বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়ে শূন্য পদের তালিকা সংগ্রহ করি। সে তালিকা পেলে ক্যাডার না পাওয়া প্রার্থীদের মধ্য থেকে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণিতে নন-ক্যাডারে নিয়োগ দেয়া হয়। আগে মন্ত্রণালয় থেকে চাহিদা দিলে নন-ক্যাডারে নিয়োগ দেয়া হতো, এখন আমরা খুঁজে খুঁজে চাহিদা সংগ্রহ করে নিয়োগের জন্য সুপারিশ করে থাকি। কেবল সংখ্যাগত পরিবর্তনই নয়, দ্রুত ফল প্রকাশের সফটওয়্যার প্রস্তুত ও ব্যবহার পাল্টে দিয়েছে পিএসসিকে। করোনা সঙ্কট সামলাতে সফটওয়্যার ব্যবহারে মাত্র ৪৮ ঘণ্টায় সাত হাজার ডাক্তার ও নার্স নিয়োগের মতো অসম্ভবকে সম্ভব করা গেছে।





বিসিএস না হলে জীবন বৃথা, তা নয়। প্রস্তুতি নিয়ে সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের পরীক্ষায়ও ভালো করা যায়
জাগো নিউজ : পিএসসিতে আমলাতান্ত্রিক জটিলতার সম্মুখীন হয়েছেন কতটা?
ড. মোহাম্মদ সাদিক : পিএসসি স্বাধীনভাবে নিজেদের কাজ করে থাকে। তবে সরকারি নিয়মনীতি মেনে ও কার্যপ্রণালীবিধি মেনে কাজ করতে হয়। কোনো আইন তৈরি করার আগে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ঘুরে পরে মন্ত্রিপরিষদে অনুমোদন দেয়া হয়। আমরা প্রশ্নফাঁস শূন্যের কোঠায় নামিয়ে এনেছি। পরীক্ষার ঠিক ৩০ মিনিট আগে লটারির মাধ্যমে প্রশ্নপত্রের সেট নির্ধারণ করা হয়। এছাড়া মৌখিক পরীক্ষার দিন সকালে বোর্ড নির্ধারণ করা হয়। এতে কে কোন বোর্ডে পরীক্ষা দেবে তা জানা যায় না।





আমরা কাজে তেমন কোনো বাধার সম্মুখীন হইনি। এ কাজে আমি সবসময় আমার সহকর্মী কমিশনের বিজ্ঞ সদস্যগণ এবং কমিশনের সচিব, সকল কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের আন্তরিক সহযোগিতা পেয়েছি। বিসিএস পরীক্ষার উত্তরপত্র পরীক্ষণের জন্য দুজন পরীক্ষক কর্তৃক মূল্যায়ন ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়েছে। এতে নিয়োগ পরীক্ষায় অধিকতর স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও নিরপেক্ষতা নিশ্চিত হয়েছে।





ড. মোহাম্মদ সাদিক : আমি পিএসসিতে দায়িত্ব নেয়ার পর প্রার্থীসহ সবার আস্থা ও বিশ্বাস ফিরিয়ে আনা, পরীক্ষা ও ফলাফল ব্যবস্থাপনা সহজতর, গ্রহণযোগ্য ও সকল কাজে আইসিটি ব্যবহার করা এবং অবকাঠামো উন্নয়ন করেছি। প্রশ্ন ও উত্তরপত্রের গোপনীয়তা রক্ষায় সব কাজ সতর্কতার সঙ্গে করার পরিবেশ তৈরি করা হয়েছে।





পরীক্ষা শুরুর ১০ মিনিট আগে লটারি করে প্রশ্ন নির্বাচন করা হয়। এর আগে পিএসসি চেয়ারম্যানও প্রশ্ন দেখেন না। প্রশ্নে কোনো ধরনের ক্রটি থাকলে তার দায়ভার কিন্তু চেয়ারম্যানের, সেই দায়ভার তিনি এড়াতে পারেন না। পরীক্ষা কেন্দ্রে প্রশ্ন বিতরণ ও পরীক্ষা গ্রহণ অধিক কড়াকড়ি করা হয়েছে। কন্ট্রোল রুম থেকে প্রশ্ন নিয়ে পরীক্ষা কক্ষে খুলতে হবে। প্রশ্ন বেশি হলে বিতরণের পর তা পিনআপ করে প্যাকেট বুঝিয়ে দেবেন শিক্ষকরা। প্রশ্নফাঁস বন্ধ নিশ্চিত করতে প্রিলিমিনারি পরীক্ষার নির্ধারিত সময় শেষের আগে কাউকে বের হতে দেয়া হয় না।





প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রধান কাজ হচ্ছে দেশপ্রেম। সেটিকে ধারণ করে সকল কাজ করতে হবে। পিএসসিতে আগে জাতীয় দিবসগুলো পালন করা হতো না, এখন সেটি করা হয়। এতে আমরা সবাই দেশপ্রেমকে সঞ্চারিত করতে পারি। পাশাপাশি পিএসসিতে মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে মৃত্যুঞ্জয়ী স্মৃতিফলক স্মারক, জাতির পিতার ম্যুরাল স্থাপন, ’৭১ মিলনায়তন ও মুক্তিযোদ্ধা গ্যালারি নির্মাণ করা হয়েছে।





ড. মোহাম্মদ সাদিক : আগে একটি পরীক্ষা শেষ হলে আরেকটি বিজ্ঞাপন দেয়া হতো। বর্তমানে প্রতি বছর একটি বিসিএস পরীক্ষার বিজ্ঞাপন দেয়া হচ্ছে। একসঙ্গে একাধিক পরীক্ষা আয়োজন করা হচ্ছে বলে প্রার্থীরা সব পরীক্ষায় অংশ নিতে পারছেন। প্রার্থীদের সুবিধার জন্য সেভাবে পরীক্ষার সময়সূচি নির্ধারণ হয়ে থাকে। একটি বিসিএস পরীক্ষার চূড়ান্ত ফল প্রকাশে দুই থেকে আড়াই বছর সময় গেলেও তার মধ্যে প্রার্থীরা দুই থেকে তিনটি বিসিএস পরীক্ষায় অংশগ্রহণের সুযোগ পায়।





২৬টি ক্যাডারের পরীক্ষা একসঙ্গে নিতে হচ্ছে। তার মধ্যে টেকনিক্যাল ও নন-টেকনিক্যাল ক্যাডার রয়েছে। পাশাপাশি নন-ক্যাডারের অনেক পরীক্ষা আয়োজন করতে হয় বলে বিসিএস পরীক্ষা দুই থেকে আড়াই বছরের আগে শেষ করা সম্ভব হয় না। যদি সিলেবাস, কারিকুলাম রিভাইজ করা হয়, তবে কিছুটা সময় কমিয়ে আনা সম্ভব হবে।





ড. মোহাম্মদ সাদিক : নন-ক্যাডারের চাহিদা সময়মতো পাওয়া যায় না। অনেক প্রতিষ্ঠান তার শূন্য পদের হিসাব জানে না। এজন্য সফটওয়্যার ডাটাবেজের মাধ্যমে কর্মকর্তা-কর্মচারীর তথ্য যুক্ত করা হলে সহজেই এ সংক্রান্ত তথ্য বের করা সম্ভব হবে। সময়মতো তালিকা পাওয়া গেলে নন-ক্যাডার পদের সংখ্যা বের করে দ্রুত সময়ে নিয়োগ দেয়া সম্ভব হবে।





ড. মোহাম্মদ সাদিক : তরুণরা জ্ঞান-বিজ্ঞানে অনেক এগিয়ে থাকে। তারুণ্যের সময়টি শ্রেষ্ঠ সময়। তাই সময়কে কাজে লাগিয়ে চলতে হবে। দিনে কতক্ষণ পড়ালেখা করবে, কতক্ষণ আড্ডা দেবে, অন্যান্য কাজ করবে, তা নির্ধারণ করতে হবে। নয়তো তারুণ্য শেষ হলে নিজের ঘরে ফসল তুলতে পারবে না সে।





শুধু গাইড বই পড়লে হবে না, এটি থেকে একটি ধারণা নেয়া যাবে। তার সঙ্গে পাঠ্যপুস্তক পড়তে হবে। সাধারণ জ্ঞান-বিজ্ঞান সম্পর্কে জানতে হবে। ইংরেজিতে কথা বলার দক্ষতা থাকতে হবে। আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশে পড়ালেখা শেষে চাকরির সন্ধানে ঘুরতে হয়। তাই শিক্ষাজীবনের শ্রেষ্ঠ সময় শ্রেষ্ঠভাবে ব্যয় করতে হবে।





বিসিএস না হলে জীবন বৃথা, তা নয়। প্রস্তুতি নিয়ে সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের পরীক্ষায়ও ভালো করা যায়। বড় মানুষ হতে হলে বিসিএস হতে হবে তা-ও নয়, মানুষ হিসেবে বড় হতে হবে।
Source : Jago News


































