



লিখেছেন ঃ ডাঃ তাহসিনা আফরিন,বিসিএস ক্যাডার
সিভিল সার্ভিস নিয়ে সবচেয়ে দারুন মন্তব্য করে গেছেন লেখক যাযাবর তার ‘দৃষ্টিপাত’ নামক অসাধারণ বইটিতে! তাও কম করে হলেও ৫০ বছর আগেই!! তার কথাকে একটু বর্তমান প্রেক্ষাপটে বসালে বক্তব্যটি হবে অনেকটা ঠিক এমন ,




“ সিভিল সার্ভিস, ভারতে ব্রিটিশ শাসনের অপুর্ব সৃষ্টি! পরাধীন জাতির মধ্য থেকেই সাম্রাজ্যবাদের সমর্থক সৃষ্টি করার প্রকৃষ্ট দৃষ্টান্ত এই সার্ভিস। স্ফীত বেতন ও লোভনীয় পেনশনের আকর্শনে বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র আকৃষ্ট করেন ব্রিটিশ গভর্মেন্ট। তরুন সম্প্রদায়ের সর্বত্তম নিদর্শন বেছে নিয়ে নিয়োজিত করেন শাসন কার্যে, যে শাসন দেশের দাসত্বকে করে দৃঢ়মূল, দারিদ্রকে করে ক্রম বর্ধমান এবং জাতীয় আন্দোলনকে করে বিঘ্ন সঙ্কুল! অসাধারণ মোহ আছে ইংরেজি বর্নমালার এই তিনটি অক্ষরে, আইসিএস ( পড়ুন বিসিএস) !! ”
প্রথমেই জানতে হবে, বিসিএস কি?
– বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস! এটা তো সবাই জানে।




যেটা সবাই জানে না, জানলেও মানে না, মানলেও অনুভব করে না তা হল … এটা একটা নিছক চাকরির পরীক্ষা নয়, এটা হল একটা লাইফ স্টাইল চয়েজ করার মতো। ছেলেবেলায় কেউ কেউ মাদ্রাসায় চলে যেত, কেউ নান-ফাদার হবার জন্য চার্চে চলে যায়, কেউ আর্মি হবার জন্য চলে যায় সামরিক বাহিনীতে … ! তাদের জীবনযাত্রা বাকি রাম সাম জদু মধুর মত হয় না। তেমনি, বিসিএস এর চাকরি ওই রকম একটা লাইফ স্টাইল!! রিটায়ারমেন্ট এবং কখনো কখনো এর পরেও বিসিএস এর চক্র থেকে মুক্ত হতে পারে না কেউ কেউ – কেউ কেউ স্বেচ্ছাবন্দী হয় – আর কেউ কেউ খাবি খেতে খেতে পার করে দিন!!
যেমন, আপনি যদি স্কয়ার হাসপাতালে চাকরি করেন, আপনার বস স্কয়ার গ্রুপের মালিক। তেমনি আপনি সরকারের চাকরি করেন, আপনার মালিক দেশের সরকার।




বিসিএস এর বাংলা মানে, আপনি এখানে প্রজাতন্ত্রের চাকর। সরকারের চাকর। জনতার চাকর। জনতা যাকে ভোট দিয়েছে তার চাকর। জনতা যাকে নেতা মানে তার চাকর। সে ফাইভ পাস হলেও আপনার স্যার। সন্ত্রাসী হলেও আপনার মাস্টার!
আপনার কাজ সরকার যেটা ভাবছে, আপনার ভাষা সরকার যেটা বলছে, আপনার ভাবনা সরকার যেটা ভাবছে। এখানে অন্য কিছু ভাবার, করার, বলার কোন সুযোগ নেই। আপনার আলোচনা কেবলই সরকারের গুন কির্তন নিয়ে। এখানে সরকারের কোন কাজের সমালোচনার কোন সুযোগ নেই। যদি সেটা করতে চান, তবে বিসিএস ভিন্ন আরও ৯৯৯টি চাকরি আপনার অপেক্ষায় আছে!!




বিসিএস পরীক্ষা পদ্ধতির এর নানা রকম সীমাবদ্ধতা!
>এটি দির্ঘ মেয়াদি পরীক্ষা, এক একটা রিক্রুটমেন্ট শেষ হতে আড়াই থেকে তিন বছর সময় নেয়।
উত্তরঃ কয়েক লাখ ক্যান্ডিডেট থেকে বাছাই করতে সময় লাগাই স্বাভাবিক।




> এতে প্রকৃত মেধা যাচাইএর সুযোগ নেই! মুখস্ত বিদ্যার জয়জয়কার।
উত্তরঃ কে বলেছে বিসিএস মেধা যাচাইয়ের পরীক্ষা?!! ভাই, বিসিএস চাকরি পাবার পরীক্ষা! এখানে দেখা হবে আপনি চাকরির জন্য কতটা নিবেদিত। সিনিওরের আদেশ কতটা বিনা বাক্য ব্যয়ে পালন করবেন। আপনি কতটা সেরা সেই পরীক্ষা এটা না। এখন কয়েক লাখের মধ্যে বাছাই করতে যেয়ে হয়ত একটা প্রতিযোগিতার প্রশ্ন চলে আসে, কিন্তু শেষ কথা সেটাই … বিসিএস মিডিওকার ব্রেনের মানুষের জন্য ডিজাইন করা। আপনি আইনস্টাইন হলে বিসিএস আপনার জন্য না।




>কোটা সিস্টেম এর মতো জঘন্য নিয়ম বিসিএস এ , এটা পেরিয়ে চান্স কি পাবো?
উত্তর – দুঃখজনক হলেও সত্যি যে, এটাও সরকারের ইচ্ছায় প্রচলিত নিয়ম। মালিক চাইবেই তার অনুগত থাকবে অপেক্ষাকৃত এমন জনগোষ্ঠী থেকে লোক নিয়োগ করার। কোন বিচিত্র কারনে সেটা বৈষম্যমূলক বোধ হয় বাকিদের কাছে। যেহেতু চাকরিটি সরকারি, যেহেতু সরকারের সমালোচনা করা যাবে না এই চাকরি পাবার পর, তাই যারা যারা এখনি মন থেকে কোটা সিস্টেম সহ বিসিএস এর মানতে কষ্ট হয় এমন ইস্যুগুলো মেনে নেয়া শিখেছেন শুধু নয়, পারলে প্রশংসা করাও শিখেছেন, তারাই বসুন এই পরীক্ষায়!!




>সাধারন জ্ঞান কেন পড়তে হবে ডাক্তারদের ? ডাক্তার হিসেবে আমাকে রোগ শোক শেখানো হোক বেশী করে। তুভ্যালুর রাজধানীর নাম জানা আমার দরকার কেন?!!
উত্তর – এটা আমাদের ডাক্তারদের সবচেয়ে বড় আবালিপনা প্রশ্ন!! বারবার বলছি, বিসিএস কোন ভাবেই কোন একটি সম্প্রদায়ের পরীক্ষা না না না!! আপনি ডাক্তার হন, ইঞ্জিনিয়ার হন, টেকনিক্যাল ক্যাডার হন আর জেনারেল ক্যাডার হন … আপনার আসল পরিচয় আপনি বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসের একজন সদস্য! আপনাকে এই চাকরির এন্ট্রি পরীক্ষা দিতে হবে একটি লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডে যেয়ে। এখানে সবাই যা জানবে, আপনারও তাই জানতে হবে নিজের বিষয়ের বাইরে যেয়েও।




এখানে হেলথ ক্যাডারে চাকরি করে যদি ভেবে নেন আপনার কাজ দিবা রাত্রি কেবল রোগী দেখা, তবে আপনি চোখ পরিস্কার করে আসুন!! জি!! আপনার এখানে রোগী দেখার কাজ হয়ত ১০%, বাকি ৯০% কাজ প্রশাসনিক কাজ – ট্রেনিং দেয়া ও নেয়ার কাজ – প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ – মাঠে মাঠে ছুটার কাজ – মিটিং কোঅর্ডিনেট করার কাজ। তাই কেন ডাক্তারদের বেশী করে ডাক্তারি শেখান হয় না, সেই প্রশ্নের উত্তর এখনি জেনে নিন, আপনি কেবল ডাক্তারি করার জন্য বিসিএস হেলথে আসছেন না। আপনি এখানে চিকিৎসা –প্রশাসক হিসেবে আসছেন। তাই তুভ্যালুর রাজধানীর নাম আপনার জানা থাকা জরুরী।




আমি কি বিসিএস দেবো?
উত্তর – যেমন আপনি কার সাথে প্রেম করবেন সেখানে আপনার ইচ্ছার প্রতিফলন করেছেন/ কাকে বিয়ে করবেন সেখানে আপনার ইচ্ছার প্রতিফলন করেছেন/ কোন সাব্জেক্টে পড়বেন সেখানে আপনার ইচ্ছার প্রতিফলন করেছেন/ ভাত পছন্দ করেন নাকি বিরিয়ানি পছন্দ করেন সেখানে আপনার ইচ্ছার প্রতিফলন করেছেন/ ঠিক সেভাবেই … বিসিএস দেবেন কি দেবেন না, সেখানে আপনার ইচ্ছার প্রতিফলন করেন।




এটা এমন একটা মাপের জুতা, যেটা প্রতিটি মানুষের জন্য আলাদা মাপে বানানো হয়। অমুক ভাই বলেছে, তমুক আপু বলেছে, অমুক এর এই হয়েছে, তমুকের তা হয়েছে, জেনারেল নাকি টেকনিক্যাল … ইত্যাদি প্রশ্নের উত্তর কেবল এবং কেবল মাত্র আপনার উপর ছেড়ে দিন।




নিশ্চিত চাকরি, বেতন ভাতা, পেনশন, ট্রেনিং এর সুযোগ, পেরিফেরির রোগীদের কাছে ভালো মুল্য – এগুলো সাদা চোখের সরকারি চাকরির ভালো দিক হতে পারে ; স্বাধীন জীবন , বেশী বেতন, উচ্চ শিক্ষার সুযোগ, উচ্চ শির – এগুলো সাদা চোখে বেসরকারি থাকার ভালো দিক হতে পারে … কিন্তু আপনি কোন সূত্রে পরছেন সেটা আপনারই ঠিক করে নিতে হবে।




এটা ৫৯ বছর পর্যন্ত করে যাবার চাকরি, নিদেন পক্ষে ৩০ বছর …!! ভেবে চিনতে পা রাখুন অথবা ভেবে চিন্তে বাদ দিন। শেষ কথা বলবো যাযাবর থেকে একটু পাল্টে,
“ বিসিএস একটি পেশা নয়, বিসিএস একটি জাত!”



