



ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের ছাত্র টি এম মোশাররফ। বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনা শেষ করে চাকরি খোঁজার পালা। ভালো চাকরির জন্য প্রস্তুটিটাও তো চাই। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা শেষ হলেও বসে থাকার উপায় নেই। চলে চাকরির জন্য জোর প্রস্তুতি। পরীক্ষাও দেন বিভিন্ন ব্যাংকসহ নানা প্রতিষ্ঠানে। শেষ পর্যন্ত টিকে যান বাংলাদেশ ব্যাংকের সহকারী পরিচালক হিসেবে। কিন্তু তাতে সন্তুষ্ট নন। পেশার ক্ষেত্রে সরকারি চাকরিই তাঁর প্রথম পছন্দ। তাই চাকরির পাশাপাশি চলে বিসিএস পরীক্ষার প্রস্তুতি। সবশেষে ২৭তম বিসিএস পরীক্ষায় বিসিএস (পুলিশ) ক্যাডারে চূড়ান্তভাবে টিকে যান। বর্তমানে তিনি ব্যবহারিক প্রশিক্ষণে রয়েছেন।




শুধু টি এম মোশাররফ নন, তাঁর মতো অনেকেই চাকরিজীবনের পছন্দের তালিকায় প্রথম রাখেন সরকারের প্রথম শ্রেণীর (ক্যাডার) চাকরি।
প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা: রাষ্ট্র পরিচালনায় সরকার নানা ধরনের সিদ্ধান্ত নেয় প্রতিনিয়ত। যেকোনো নির্বাচিত সরকার রাষ্ট্রের প্রশাসক হিসেবে কাজ করে। আর তাদের নেওয়া নানা সিদ্ধান্ত ও কর্মকাণ্ড বাস্তবায়নের দায়িত্ব থাকে প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের। প্রশাসনের কেন্দ্র থেকে মাঠ পর্যায় সব ক্ষেত্রেই কাজ করতে হয় তাঁদের। উপজেলা প্রশাসন, জেলা প্রশাসন, বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়, বিভিন্ন দপ্তর-অধিদপ্তর থেকে সচিবালয় পর্যন্ত কাজ করতে হয় এঁদের। দপ্তর ও পদভেদে এঁদের কাজের ধরনের মধ্যে পার্থক্য থাকলেও মূলত সবাই নিয়োজিত থাকেন জনসেবায়। এককথায় বলতে গেলে তাঁরা প্রজাতন্ত্রের সেবক।




ক্যাডার পরিচিতি: শুরুর দিকে সরকারি কাজের জন্য ৩০টি ভিন্ন ক্যাডার নিয়োগের বিধান ছিল। পরে বিসিএস প্রশাসন ও সচিবালয়কে একীভূত করা হয়। সর্বশেষ আরও একটি ক্যাডারকে বাদ দেওয়া হয় এবং একটির জন্য স্বাধীন কমিশন গঠন করা হয়েছে। পিএসসি সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে ১৫টি সাধারণ ও ১২টি পেশাগত বা কারিগরি ক্যাডার রয়েছে। এসব ক্যাডারে নিয়োগপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের সংশ্লিষ্ট দপ্তরের নানা বিভাগে বিভিন্ন পদে নিয়োগ দেওয়া হয়। জনসেবা (পাবলিক সার্ভিসেস) সংশ্লিষ্ট কাজে প্রধান ভূমিকায় থাকেন মেধাবী কর্মকর্তারা।
বিসিএস কেন: প্রজাতন্ত্রের প্রথম শ্রেণীর কর্মকর্তা হিসেবে জনসেবা করতে চাইলে বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসেস (বিসিএস) পরীক্ষা দিয়ে আসতে হবে আপনাকে। সাংবিধানিকভাবে এর দায়িত্ব রয়েছে বাংলাদেশ সরকারি কর্মকমিশনের ওপর।
১৯৭৭ সালে




সরকার বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিসেস অধ্যাদেশ জারি করে এবং বর্তমান বাংলাদেশ কর্মকমিশন (পিএসসি) গঠিত হয়। উন্মুক্ত প্রতিযোগিতার মাধ্যমে যথাযথ প্রক্রিয়ায় জনসেবার জন্য প্রার্থী বাছাই করাই হচ্ছে পিএসসির মূল কাজ। আর প্রতিযোগিতামূলক ওই প্রক্রিয়াটি বিসিএস পরীক্ষা নামে পরিচিত।
ক্ষমতাবলে বাংলাদেশ সরকারি কর্মকমিশন বিসিএস পরীক্ষার আয়োজন করে। বিভিন্ন মন্ত্রণালয় বা বিভাগ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের শূন্য ক্যাডার পদের বিবরণ সংস্থাপন মন্ত্রণালয়কে জানায়। সংস্থাপন মন্ত্রণালয় সেই পরিপ্রেক্ষিতে পিএসসিকে চাহিদাপত্র দেয়। পিএসসি ১৯৮২ বিধান মোতাবেক (সরাসরি নিয়োগের জন্য বয়স, যোগ্যতা ও পরীক্ষা) পরীক্ষা নিয়ে যোগ্য প্রার্থীদের নিয়োগের সুপারিশ করে।
পরীক্ষার তথ্য: এ পর্যন্ত ২৮টি বিসিএস পরীক্ষা চূড়ান্তভাবে শেষ হয়েছে। ২৮তম বিসিএস পরীক্ষার চূড়ান্ত ফল সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে। প্রকাশিত হয়েছে ২৯তম লিখিত পরীক্ষার ফলও। এর মৌখিক পরীক্ষাও শিগগিরই শুরু হবে। ৩০ জুলাই ৩০তম বিসিএসের প্রিলিমিনারি পরীক্ষা সারা দেশে একযোগে অনুষ্ঠিত হবে।
ক্যাডারগুলো: এ পরীক্ষায় ২৭টি ক্যাডারে মোট শূন্য পদ দুই হাজার ৫৭২টি। সাধারণ ক্যাডারের ৮৩১টি বাদে বাকিগুলো পেশাগত বা কারিগরি ক্যাডার। সাধারণ ক্যাডারগুলো হচ্ছে বিসিএস প্রশাসন, পররাষ্ট্র, পুলিশ, নিরীক্ষা ও হিসাব, আনসার, শুল্ক ও আবগারি, সমবায়, খাদ্য, পরিবার পরিকল্পনা, ডাক, রেলওয়ে পরিবহন ও বাণিজ্যিক, কর, বাণিজ্য, ইকোনমিক ও তথ্য। আর পেশাগত বা কারিগরি ক্যাডারের নামগুলো বিসিএস কৃষি, মৎস্য, খাদ্য, স্বাস্থ্য, তথ্য, সড়ক ও জনপথ, রেলওয়ে প্রকৌশল, জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল, গণপূর্ত, পরিসংখ্যান, পশুসম্পদ ও শিক্ষা।




পছন্দের তালিকা: বর্তমানে সরকারের একটি অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের দায়িত্বে আছেন অতিরিক্ত সচিব পদমর্যাদার একজন কর্মকর্তা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা শেষ করে বিসিএস পরীক্ষা দেন। প্রথমবার হয়ে যায় একটি ক্যাডারে। কিন্তু যোগ দেন না। কারণ তাঁর পছন্দ ছিল, তিনি প্রশাসন ক্যাডারে যোগ দেবেন। পরেরবার প্রশাসন ক্যাডারে হয়ে যায়। কোন ক্যাডারে যাবেন আপনি, সেটি নির্ভর করবে আপনার পছন্দের ওপরই। তবে সঙ্গে মিলতে হবে ফলাফল, কোটা, শূন্যপদ ইত্যাদি। কথা হয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব বর্তমানে ফরেন একাডেমির অধ্যক্ষ মো. তৌহিদ হোসেনের সঙ্গে। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা শেষ করে ১৯৮১ সালে বিসিএসে (পররাষ্ট্র) যোগ দেন। কেন এই ক্যাডারে এলেন? উত্তরে বলেন, ‘আমাকে তৎকালীন মৌখিক বোর্ডে এ প্রশ্ন করা হয়েছিল। আমি বলেছিলাম, আমার পৃথিবীটা ঘুরে বেড়ানোর খুব ইচ্ছা। কিন্তু পরিবারের সীমিত আর্থিক সামর্থ্যে তা সম্ভব নয়। তাই এই পররাষ্ট্র ক্যাডারে যেতে চাই।’




পছন্দের তালিকায় অনেকে রাখেন পুলিশ ক্যাডারকে। বাংলাদেশ পুলিশের অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক ও পুলিশ স্টাফ কলেজের রেক্টর হিসেবে কর্মরত নাইম আহমেদ। তিনি ১৯৮৪ সালে (বিসিএস ১৯৮২ সালের ব্যাচ) সহকারী পুলিশ সুপার হিসেবে চাকরিতে যোগ দেন। পড়াশোনা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। কেন পুলিশ ক্যাডার পছন্দ? উত্তরে নাইম আহমেদ বলেন, ‘পারিবারিকভাবে ছোটবেলা থেকেই ইউনিফর্ম চাকরির সঙ্গে আমার পরিচয় ঘটে। কারণ আমার দুই ভাই ও এক ভগ্নিপতি সামরিক বাহিনীর ঊর্ধ্বতম কর্মকর্তা ছিলেন। আমারও জনসম্পৃক্ত কাজে নিজেকে নিয়োজিত করতে ইচ্ছে ছিল ও পছন্দে ছিল সরকারি চাকরি। তাই বিসিএস পরীক্ষা দিই এবং আমার প্রথম পছন্দ পুলিশ ক্যাডারেই আমি টিকে যাই।’
চাহিদার প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে নেই বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারও। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের উপসচিব মো. মাহবুব হোসেন বলেন, ‘আমি প্রশাসন ক্যাডার পছন্দ করেছিলাম মূলত নানা মানুষ ও নানা কাজের সঙ্গে নিজেকে সম্পৃক্ত করতে পারব চিন্তা করে। তা ছাড়া আমার মতে, প্রশাসন ক্যাডারদের সামাজিক মর্যাদা অন্য ক্যাডারের চেয়ে বেশিই মনে হয়। দেশের সাধারণ মানুষের সঙ্গে মেশার সুযোগও পাওয়া যায় এর মাধ্যমে।’




- সাধারণ ও পেশাগত বা কারিগরি কোনো ক্যাডারকে আসলে ছোট করে দেখার কোনো সুযোগ নেই। পছন্দের তালিকায় বাদ যায় না সাধারণ ক্যাডারের বাণিজ্য, কর, নিরীক্ষা ও হিসাব এবং রেলওয়ে পরিবহন ও বাণিজ্যিক ক্যাডার। কারিগরি ক্যাডারে স্বাস্থ্য, খাদ্য, গণপূর্ত এবং শিক্ষকতা বেশির ভাগের নির্বাচনের তালিকার শীর্ষে থাকে। তবে যে ক্যাডারেই আপনি টেকেন, মনে রাখবেন, আপনি হতে যাচ্ছেন প্রজাতন্ত্রের প্রথম শ্রেণীর (ক্যাডার) কর্মকর্তা।
ক্যাডার নির্বাচনে আপনাকে অব্যশই নিজের পছন্দকে গুরুত্ব দিতে হবে। আর সেভাবেই প্রাথমিক আবেদনপত্রে তা লিখেছেন নিশ্চয়ই। মনে রাখতে হবে, আপনি আবেদনপত্রে যদি কোনো ক্যাডার পছন্দের তালিকায় না রাখেন, তবে তা আর পরে যোগ করতে পারবেন না।



