১৭ তারিখ, সোমবার। আন্তর্জাতিক বিষয়াবলীর পরীক্ষা। টেনশনে পরীক্ষার পুরো সময়টা হলে থাকলাম না। আমার তো আর গাড়ি নেই, যদি সিএনজি’তে এয়ারপোর্ট পৌঁছাতে দেরি হয়ে যায়! যদি ফ্লাইট মিস করে ফেলি! ৩:২০টায় ফ্লাইট। আর ওমর গনি এমইএস কলেজ থেকে দুপুর ১টায় এয়ারপোর্টে পৌঁছতে কমপক্ষে ২ ঘণ্টা লাগার কথা।




আমাদের লিখিত পরীক্ষা হয়েছিল শীতকালে। প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় হাতের আঙুলগুলি জমে যেত। তবুও বারবার দুইহাতের তালু ঘষেঘষে গরম করে, মুখ থেকে গরম হাওয়া দুইহাতের খোপের ভেতর চালিয়ে দিয়ে লিখলাম নিজের সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে। ১টার পরিবর্তে ১২:৩০টায় পরীক্ষা শেষ করে খাতা জমা দিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। হল থেকে বের হয়ে গেইটে আসার পর সবাই ভাবছিল, আমি বোধ হয় এক্সপেল্ড হয়ে গেছি! প্রচণ্ড টেনশনের ছাপ মুখের উপরেই ফুটে উঠেছিল। অনেকেই আমাকে সহানুভূতি দেখালেন, দুঃখ করতে নিষেধ করলেন, পরের বিসিএস’টা ভাল করে দিতে বললেন।




আমার উত্তর দেয়ার সময় ছিল না। উত্তর দেবো কী, ওইসময়ে জীবনটাই ছিল আমার কাছে বিশাল একটা প্রশ্ন! মায়ের শরীরে কী শক্তি ভর করেছিল, আমি জানি না। মা আমার চাইতে দ্বিগুণ গতিতে অনেকটা দৌড়ে কলেজপ্রাঙ্গন থেকে রাস্তা পর্যন্ত এলেন। একটা সিএনজি’তে দরাদরি না করে প্রায় দেড়গুণ ভাড়ায় উঠে গেলাম। উনাকে বললাম, আপনি যেভাবেই পারেন, দুই ঘণ্টার মধ্যে আমাদেরকে এয়ারপোর্টে পৌঁছে দেবেন, প্রয়োজনে আপনাকে ভাড়া বাড়িয়ে দেবো। তখন ঘড়িতে ১২:৫০টা। সিএনজি ছুটতে লাগল। মা টিফিনবক্স খুলে খিচুড়ি, মাংস আর ডিমভাজি খাইয়ে দিলেন।




আমার মাথায় একটা ব্যাপারই বারবার ঘুরপাক খাচ্ছে, “প্লেন ধরতে পারব তো? জ্যামে আটকে গেলে তো সব শেষ!” আমি গায়ের সোয়েটারটা খুলে ফেললাম। ভাইভার ড্রেস শুধু টাই ছাড়া বাকিটা পরেই সকালে বাসা থেকে বেরিয়েছিলাম। ২বার ছোটখাটো জ্যাম থেকে ছুটে যখন এয়ারপোর্টে পৌঁছলাম তখন ৩টা বাজতে ৫ মিনিট বাকি। নেমেই মাকে আর মাসিকে প্রণাম করে (আমার দূরসম্পর্কের এক মাসি আমাদের সাথে এসেছিলেন, মা তো আর একা এয়ারপোর্ট থেকে বাসায় ফিরতে পারবেন না, তাই) দৌড়ে কাউন্টারে ছুটে গেলাম। গিয়ে শুনি, ঘন কুয়াশার কারণে ১ ঘণ্টা ফ্লাইট ডিলে। ভাবলাম, ওইসময়ে প্লেন ছাড়লে তো আইবিএ’তে কোনভাবেই ৫:১৫টার মধ্যে পৌঁছানো সম্ভব নয়। কাউন্টারের ওদেরকে জানালাম এটা। ওরা বলল, কিছুই করার নেই, ওরা খুব দুঃখিত। খবর নিয়ে জানলাম,




ওইসময়ে অন্যকোনও ফ্লাইটও ছাড়ছে না। সেই মুহূর্তে নিজেকে ভীষণ অসহায় লাগছিল, শুধুই কান্না পাচ্ছিল। মনে হচ্ছিল, আমার কেউ নেই, আমার কেউ নেই! কাউন্টারে-কাউন্টারে ঘুরতে লাগলাম। জানতে পারলাম, বাংলাদেশ বিমানের একটা ফ্লাইট আছে যেটা ৩:৪৫টায় ছাড়বে। এর আগে আর কোনও ফ্লাইটই নেই। ওটা বড় প্লেন, পৌঁছতে লাগে ৩০ মিনিট, অন্য প্লেনের যেখানে লাগে অন্তত ৪০ মিনিট। মানে, আমি সোয়া ৪টার মধ্যেই ঢাকা এয়ারপোর্টে পৌঁছে যাব! তখনই টিকেট কিনে ফেললাম। মনের মধ্যে বড় আশা, যদি এটা ঠিক সময়েই ছাড়ে, তবে আর চিন্তা নেই। এয়ারপোর্টের রেস্টরুমে গিয়ে দ্রুত টাইটা পরে ফেললাম। শার্টের ইনটা আরও একবার ঠিক করে নিলাম। লুকিং গ্লাস দেখে হাত দিয়ে চুলগুলি ঠিক করে নিলাম। ৩:৪৫টা পেরিয়ে ঘড়ির কাঁটা ৪টা ছুঁল। কুয়াশার জন্য প্লেন ছাড়তে দেরি হচ্ছে।




আমরা সবাই সোয়া ৪টায় প্লেনে উঠে বসলাম। জীবনে প্রথমবারের মত প্লেনে উঠেছি। বারবারই মনে হচ্ছিল, কখন ছাড়বে, কখন ছাড়বে! প্রতিটি সেকেন্ডকে মনে হচ্ছিল একেকটা ঘণ্টা! টেনশনে শ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে, তবু প্লেন ছাড়ে না। মনে হচ্ছিল, ইসস! যদি নিজের সবটুকু শক্তি খরচ করে হলেও প্লেনটাকে আকাশে উড়িয়ে দিতে পারতাম! রুমালটা চোখের উপর চেপে ধরে কান্না লুকালাম। অবশেষে প্লেন ছাড়ল। ঘড়িতে তখন ৪:৩৭টা। ভাবছিলাম, ইসস! প্লেনটা যদি ট্যাক্সিং না করেই সরাসরি উড়ে যেতে পারত! দুএক মিনিট অন্তত বেঁচে যেত! ঢাকার রানওয়েতে প্লেন নামল ৫:১৩টায়।




ডোমেস্টিক টার্মিনাল দিয়ে প্রাণপণে দৌড়ে বের হয়ে এসে হাঁপাতে-হাঁপাতে দেখলাম একটা মোটরসাইকেল ঠিক আমার সামনে এসে থামল। “আপনি সুশান্ত, রাইট? পিছনে বসুন!” কালো হেলমেট-পরা যুবকটির সাথে হাত মেলানোর জন্য হাত বাড়িয়ে দিলাম। উনি ব্ল্যাকগ্লাভস-পরা ডান হাতের পাঞ্জাটি হ্যান্ডশেক করার জন্য ওঠালেন না। “সময় নষ্ট হচ্ছে, ভাই! প্লিজ উঠুন! কুইক!” আর কথা বাড়ালাম না। “আপনি বোধ হয় বাইকে চড়তে অভ্যস্ত না, ঠিক না?” “হ্যাঁ। আপনি জানলেন কীভাবে?” “ভাই, আমি বাইক চালাই গত ১৮-২০ বছর ধরে। আমি বুঝতে পারছি।” “আচ্ছা।” “সামনের দিকে ঝুঁকে আমার পিঠে আপনার বুকটা শক্ত করে লাগিয়ে বসুন! আমাকে জড়িয়ে ধরেও বসতে পারেন, নাহলে ছিটকে পড়ে যাবেন। শিওর!




আমি জোরে চালাবো।” বাইকটা এয়ারপোর্ট থেকে যেভাবে বেরিয়ে গিয়েছিল, সেকথা আজ আমার ভাবতেও সাহস হয় না। স্বাভাবিক অবস্থায় হলে আমি হয়তোবা ভয়ে চিৎকার করে উনাকে থামাতে বলতাম কিংবা সত্যিই ছিটকে পড়ে যেতাম। কিন্তু সেসময় আমি জানতাম, এই মুহূর্তে ভয় পাওয়াটা যতটা জরুরি, তার চাইতে অনেকবেশি জরুরি জীবিত অবস্থায় আইবিএ’তে পৌঁছানো। ১৫০ সিসি বাইকের চাকা সেদিন সত্যি-সত্যি মাটি ছুঁয়েছিল কি না জানি না, তবে আমি এটা জীবনে দ্বিতীয়বারের মতো বুঝতে পারলাম, স্বপ্নছোঁওয়ার জন্য যে জীবনবাজি রাখে, তাকে ভয় দেখানো সম্ভব নয়। কোনও বাইক ওরকম রেকলেসভাবে রাস্তায় ছুটতে পারে, এটা আমি শুধু মুভিতেই দেখেছি। আক্ষরিক অর্থেই বাতাসের শোঁশোঁ শব্দকে কাটিয়ে-কাটিয়ে বাইক যেন হাওয়ায় ছুটে যাচ্ছিল! “আচ্ছা ভাই, আপনি কি অনেক বড় কেউ?” “মানে?” “না, ম্যাডাম বললেন, উনার অনেক গুরুত্বপূর্ণ একজন বন্ধুকে যে করেই হোক, আধা ঘণ্টায় এয়ারপোর্ট থেকে আইবিএ’তে পৌঁছে দিতে হবে।




এটা উনার অর্ডার! আপনি কে ভাই? হাহাহাহা………” “আমি ম্যাডামের ফেসবুক ফ্রেন্ড।” “কন কী মিয়া? ক্যাম্নে কী! আমি তো আরও ভাবলাম….. মানে উনার সাথে আপনার কোনওদিনও দেখা হয়নি?” “না ভাইয়া। কেন?” (সামনে একটা রেললাইন। ব্যারিয়ারটা নামছে।) “ভাই, মাথাটা একটু নিচু করেন।” বলেই উনি সিগন্যাল না মেনেই দ্রুত ব্যারিয়ারের নিচ দিয়ে বাইক চালিয়ে নিলেন। পেছন থেকে অনেকেই চিৎকার করে থামতে বলছিলেন। “ভাই, আপনি জাস্ট ভয় পাবেন না। কিছুই হবে না। চোখ বন্ধ করে রাখতে পারেন চাইলে।” ঠিক ওইসময়ে দুটো পাশাপাশি দাঁড়িয়ে-থাকা ট্রাকের মাঝখান দিয়ে দ্রুত বেরিয়ে যাওয়ার সময় বললেন, “একটু ছোট হয়ে বসেন, ভাই!” এর কিছুদূর পরেই বিশাল সিগন্যালের জ্যাম! রোমেল ভাই বাইক তুলে দিলেন ফুটপাথের উপরে। “ভাই, প্লিজ একটু সাইড দেন, একটু সাইড দেন।” বলে-বলে সামনের দিকে ছুটছিলেন। এরকম কয়েকবারই করতে হয়েছে উনাকে। কখনও-কখনও রাস্তার মাঝখানের ডিভাইডারের উপরে বাইক তুলে ছোটার সময়ে ট্রাফিক পুলিশ এসে ধরলে কাঁদো-কাঁদো স্বরে “স্যার, আমার খালা মেডিক্যালে মৃত্যুর সাথে লড়াই করছেন। আমি রক্ত দিতে যাচ্ছি। ও-নেগেটিভ রক্ত, পাওয়া যাচ্ছে না। সময়মত পৌঁছাতে না পারলে খালাকে বাঁচানো যাবে না, স্যার!” বলেই পুলিশকে ম্যানেজ করে আবার সেই গতিতে ছুট!




যখনই রাস্তায় জ্যাম লেগে যাচ্ছিল, তখনই রাস্তা বদলে অন্য রাস্তা। সেদিন বুঝলাম, রাস্তায় বাধা আসা মানেই কিন্তু রাস্তা নেই, তা নয়। বরং এর মানে, অন্য রাস্তা ধরতে হবে! এখুনিই!! ওরকম দুর্ধর্ষ বাইকিং আমি শুধু হলিউডের অ্যাকশন মুভিতে দেখেছি। বাইকের মিররে আমার চুলগুলি দেখে মনে হচ্ছিল, যেন ইলেকট্রিক শক খেয়ে খাড়া হয়ে গেছে! চোখেমুখে রাজ্যের ধুলোবালি। প্রচণ্ড হাওয়ায় গলার টাইটা ওপরে উঠে শূন্যে উড়ছে পেছন দিকে। অফিসছুটির সময়ে ঢাকার রাস্তায় এরকম রেকলেসলি বাইক চলতে কেউ কখনও দেখেছে কি না,




আমি জানি না। তবে আমি, কেন জানি না, সত্যিই একটুও ভয় পাইনি। বারবারই মনে হচ্ছিল, “কতটা কম দেরি করে আইবিএ’তে পৌঁছানো যায়!” রোমেল ভাই ঢাকা কলেজ থেকে অনার্স-মাস্টার্স শেষ করে ব্যাংকে জয়েন করেছিলেন। উনাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, “ব্যাংকে আপনার ডেজিগনেশনটা কী?” উনি মজা করে বলেছিলেন, “বেশি না, আর মাত্র ১৪টা প্রমোশন পেলেই আমি জোহরা ম্যাডামের চেয়ারে বসতে পারব। হাহাহাহা…….”